৭ নভেম্বর: সেনানিবাসে বিশৃঙ্খলা ও মুক্তিযোদ্ধা সেনা হত্যার ষড়যন্ত্রময় অধ্যায়
১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাত ১২টার পর থেকেই বিশৃঙ্খলা শুরু হয় ঢাকা সেনানিবাসে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য কুশীলব ও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে হত্যা ও লুটপাট শুরু করে পাকিস্তানফেরত সৈন্যরা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এটি একটি ন্যাক্কারজনক অধ্যায়।
১৫ আগস্টের বর্বরতার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য ৩ নভেম্বর যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তারা, সেই উদ্যোগের অপমৃত্যু ঘটে। রাতভর নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে হত্যা করা হয় একজন নারী চিকিৎসকসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে। ৭ নভেম্বর সকালে নির্মমভাবে খুন করা হয় তিনজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা সেনা অধিনায়ককে। এরপর খুনিদের দায়মুক্তি প্রদান এবং নিজেকে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান। দেশজুড়ে পুনর্বাসন করা শুরু হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের। ভূলুন্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উত্থান ঘটে উগ্রবাদ ও মৌলবাদের।
জিয়াউর রহমানের নীলনকশা ও সেনানিবাসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ
মূলত বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিরা যখন বঙ্গভবনে বেপরোয়া-বিলাসী সময় কাটাচ্ছিল, ঠিক একই সময়ে সেনানিবাসের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় জন্য সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে আহ্বান জানান সিজিএস খালেদ মোশাররফ, ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সাফায়াত জামিল, বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামানরা। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজের সমর্থনপুষ্ট খুনিদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাওয়ার ব্যাপারেও দ্বিমত পোষণ করে সে। সেনাপ্রধানকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে, পরবর্তীতে নিজেরাই কিছু একটা করার চেষ্টা করেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর মধ্যরাতে, তথা ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দি করে বঙ্গভবন ঘেরাও করেন খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল, এটিএম হায়দার ও হুদার অনুগত সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরা। তাদের চাপের মুখে পরের দিন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। কিন্তু এরমধ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্যার মদদদাতা ও স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে: বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দিয়েই অতি গোপনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান ও এইচএম মনসুর আলীকে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দেশ ছাড়ার পর এই তথ্য জানতে পেরে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসাররা।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার পর কক্ষচ্যুত হয়ে যাওয়া, টালমাটাল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা উপায় খুঁজছিলেন অভ্যুত্থানকারীরা। ঠিক একই সময় ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে যাচ্ছিল গৃহবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে মত্ত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরকে ব্যবহার করে সে। তাহের তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে উস্কানিমূলক লিফলেট বিতরণ করান সেনানিবাসে। সাধারণ সৈনিকদের ক্ষেপিয়ে তোলো হয় অফিসারদের বিরুদ্ধে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে সেনানিবাসে। চারপাশে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। পাকিস্তানফেরত সৈনিকরা মেতে ওঠে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে।
প্রাথমিকভাবে নিজেকে মুক্ত করতে তাহেরের সাহায্য নিলেও, পরবর্তীতে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার পর নিজের আসল রূপ দেখায় জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের বীর অধিনায়কদের হত্যার পর, ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে তাহেরকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় সে। সেনানিবাসে বিশৃঙ্খলার পুরো দায় চাপিয়ে দেয় তাহেরের ওপর। সেনানিবাসে যেহেতু রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাই উচ্চাভিলাষী তাহেরকে বিপদে ফেলাটা খুব সহজ হয়ে যায় সুচতুর জিয়ার জন্য।
বঙ্গবন্ধুর খুনি মহিউদ্দিন ও জিয়াউর রহমানের কলঙ্কজনক যুগলবন্দি
১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর, রাত ১২ টার পর, তথা ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে উত্তেজনা শুরু হয় সেনানিবাসের দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের সামনে। উত্তেজিত সেপাইদের নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিন। ১৫ আগস্ট কালরাতে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি লক্ষ্য করে আর্টিলারি গান থেকে ৭-৮টি গোলা ছুঁড়েছিল সে। বঙ্গবন্ধুর সব খুনি দেশ ছাড়লেও, এই মহিউদ্দিনকে তারা কোনো বিশেষ কারণে দেশে রেখে গিয়েছিল। এরপর নিয়মিত জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সেনানিবাসে অবস্থান করে সে। এই খুনি মহিউদ্দিনই জিয়াকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে যায়।
এরপর জিয়াউর রহমান উস্কে দেয় উপস্থিত উত্তেজিত সৈনিকদের, ফলে ক্রমেই নৃশংস হয়ে ওঠে তারা। এসব সৈনিকের অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানফেরত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো ব্যাটেলিয়ন এদের সঙ্গে ছিল না। এদের নারকীয় বর্বরতায় সেই রাতে একজন নারী চিকিৎসকসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রীকেও হত্যা করে তারা।
৭ নভেম্বর দিনের বেলা জিয়াউর রহমানের নির্দেশে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও কে ফোর্সের প্রধান খালেদ মোশাররফ, সেক্টর কমান্ডার ও ক্রাক প্লাটুনের অন্যতম উদ্যোক্তা লে. কর্নেল এটিএম হায়দার ও সাব-সেক্টর কমান্ডার ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কর্নেল হুদাকে।
এরপর, ৭ নভেম্বর কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার নস্যাৎ করতেই দিনটিকে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি জিয়াউর রহমানের এটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ। একই সঙ্গে জাসদের লোকরা এই দিনটিকে সিপাহী বিপ্লব বলে চালানোর চেষ্টা করে।
তবে নভেম্বরের এই ষড়যন্ত্র ও হত্যাযজ্ঞ নিয়ে সামরিক বাহিনীর একাধিক কর্মকতার গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ৭ নভেম্বরের কোনো ঘটনার রেশ পড়েনি বাইরে। সারা দেশের কোথাও কোনো বিপ্লব হয়নি। কেউ সংহতিও জানায়নি। এমনকি সিপাহী বিপ্লব আখ্যা দিয়ে রাতভর সেনা অফিসারদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর যে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়; তার সঙ্গে পুরো সেনাবাহিনীর সব সৈনিকরাও জড়িত নয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব বেঙ্গল ইউনিটের কেউ এতে অংশ নেয়নি।
৭ নভেম্বর নিয়ে বিএনপির বর্বরতা ও অপরাজনীতি
বামপন্থী কয়েকটি দলও এই দিনটিকে 'সিপাহী বিপ্লব' হিসেবে ঘোষণা করে নিজেদের ঐতিহাসিক ভুল ও দুর্বলতাকে ঢাকার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কারণ, জিয়াউর রহমানের ফাঁদে পা দিয়ে কর্নেল তাহের ও তার সতীর্থরা যে ভুল করেছিলেন, তাদের সেই উচ্চাভিলাসের মাসুল দিতে হয়েছে জিয়ার হাতেই নিজেদের জীবন দিয়ে। এমনকি স্বাধীনতার পর থেকে বিপ্লবের স্লোগান তুলে তারা লাখ লাখ সম্ভাবনাময় তরুণকে যেভাবে উস্কে দিয়েছিল, তাদের এই রাজনৈতিক ভুলের পর সেই স্বপ্ন রাতারাতি নস্যাৎ হয়ে গেছে। কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে প্রতারণার দায় এড়াতে, নিজেদের রাজনৈতিক ভুল ঢাকতে, তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সেনা অধিনায়কদের নির্মম মৃত্যুর দিনকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, এটাই হয়তো তাদের নিয়তি!
অন্যদিকে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞের ওপর ভর করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। সৈনিকদের ব্যবহার করে, মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্তের ওপর দিয়ে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের ভিত্তি রচনা করে সে। একইসঙ্গে এই রাতের দুর্বত্তায়নের সঙ্গে জড়িতদের পদায়ন করে বিভিন্ন স্থানে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের নিষ্ঠুরভাবে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া রুদ্ধ করে দেয়।
এজন্য এই দিনটিকে রাজনৈতিক রং দিয়ে 'জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয় জিয়ার নির্দেশে। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট নিয়মিত এই দিনটিকে উদযাপন করে আসছে। অথচ, এটি বাঙালি জাতির ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় দিন। শোকের দিন এটি, কান্নার দিন।